এই অধ্যায় শেষে শিক্ষার্থীরা নিচের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারবে—
- আলোর রং
- প্রতিফলন প্রতিসরণ ও শোষণ
- কীভাবে দেখি এবং রং এর ধরন
আলো সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, আমরা চোখে যেটা দেখি সেটা হচ্ছে আলো। তবে সেটা পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক একটা কথা হলো না কারণ চোখে আমরা মানুষ, গাছপালা, আকাশ, মেঘ অনেক কিছু দেখি— সেগুলো কি আলো? না, সেগুলো আলো না কিন্তু সেগুলোতে আলো পড়ে বলে সেখান থেকে আলো যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে তখন আমরা সেগুলোকে দেখি।
যদি অন্ধকার হয়ে যায় কিংবা যখন আমরা চোখ বন্ধ করে কোনো আলোকে চোখে আসতে না দিই, তাহলে আমরা কিছুই দেখিনা।
আলো
তোমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছ একটা জবা ফুলকে কেন আমরা লাল দেখি আর জবা ফুলের পাতাকে কেন সবুজ দেখি? সেটি যদি বুঝতে চাও তাহলে আলো সম্পর্কে আমাদের আরও একটু জানতে হবে।


আলোর রং
তোমরা এর মধ্যে জেনে গেছ যে বিজ্ঞানী নিউটন পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন যে, সূর্যের আলো—যেটা বর্ণহীন কিংবা সাদা আলো সেটা আসলে বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা এবং
লাল রং দিয়ে তৈরি। সবগুলো একসঙ্গে মিশে থাকলে আমাদের চোখে সেটাকে বর্ণহীন বা সাদা রং হিসেবে দেখা যায়।
সূর্যের আলোতে যে এই সাতটি রং আছে সেটা আমরা নিজেরাও রংধনুতে দেখেছি, সেখানে সূর্যের আলো সাত রঙে ভাগ হয়ে যায়।
গানের বা কম্পিউটারের যে সিডি পাওয়া যায়, সেখানে আলো প্রতিফলিত করলেও সেখানে সাতটি রংকে ভাগ হয়ে যেতে দেখা যায়।
কাজেই আমরা যখন একটা জবা ফুলকে লাল দেখি তার অর্থ সবগুলো রংয়ের সংমিশ্রণে তৈরি সাদা রং এই ফুলে পড়ার পর লাল
ছাড়া অন্য সব রং শোষিত হয়ে গেছে—তাই সেখান থেকেই শুধু লাল রংটা বের হয়ে আমাদের চোখে পর্যন্ত আসতে পারছে। সে কারণে আমরা ফুলটা দেখছি লাল।
ঠিক সেরকম আমরা গাছের পাতাকে সবুজ দেখি কারণ, সেখানে সব রংয়ের মিশ্রণ তৈরি সাদা আলো পড়ার পর সবুজ ছাড়া অন্য সব রং শোষিত হয়ে গেছে—তাই সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসা সবুজ রংটা যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে তখন আমরা সেটাকে সবুজ রংয়ের দেখি ।
বিষয়টা যে সত্যি, তোমরা ইচ্ছা করলেই সেটা নিজেরাও পরীক্ষা করে দেখতে পারো। লাল ফুলকে তুমি যদি সবুজ আলোতে দেখার চেষ্টা করো তাহলে ফুলটাকে দেখবে কুচকুচে কালো! কারণ সবুজ রংটা জবা ফুলে শোষিত হয়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে কোনো রংয়ের আলোই বের হবে না, তাই সেটা দেখাবে কালো। ঠিক একই কারণে লাল আলোতে সবুজ পাতাটাকে দেখাবে কুচকুচে কালো।

কাজেই তোমরা বুঝতে পারছ কোনো কিছুর রং কালো হওয়ার অর্থ সেখানে সব রং শোষিত হয়ে যায়। ঠিক সেরকম কোনো কিছুর রং সাদা হওয়ার অর্থ, সেখানে কোনো রং শোষিত হয় না! একটা কালো কাপড় আরেকটা সাদা কাপড় রোদে শুকাতে দিলে তুমি দেখবে কালো কাপড়টা অনেক তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় কারণ কালো রং হওয়ার কারণে সেটি আলোর সব রং শোষণ করে রাখে বলে সেটা বেশি গরম হয়ে বেশি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যেতে পারে।
একটু আগে তোমাদের বলা হয়েছে সাদা আলোর রংগুলো যদি ভাগ করা হয় তাহলে সেখান থেকে রংগুলো যথাক্রমে বেগুনি নীল আসমানি সবুজ হলুদ কমলা লাল এই ভাবে ভাগ হয়:

এবারে একটা বিচিত্র প্রশ্ন করা যাক, বেগুনির আগে কি কোনো রং আছে? আবার লালের পর কি কোনো রং আছে? সত্যি কথা বলতে কি বেগুনির আগের রংটির নাম অতিবেগুনি এবং লালের পরের রংটি হচ্ছে অবলাল! তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সেই রংগুলো দেখতে পাই না!
পোকামাকড় অতিবেগুনি রং খানিকটা দেখতে পায়, তাই দেখা যায়, পোকামাকড় ধরার জন্য অনেক সময় অতিবেগুনি ধরনের আলো ব্যবহার করা হয়। অবলাল রংটি টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোলেও ব্যবহৃত হয়। তোমার চোখে সেই রং দেখতে না পেলেও স্মার্টফোনের ক্যামেরা সেই রং দেখতে পারে, তাই তোমরা ইচ্ছা করলে একটা স্মার্টফোনের ক্যামেরার সামনে রিমোট কন্ট্রোল চেপে ধরে সেই আলোকে দেখতে পারো।
আলো কিন্তু একদিকে অতিবেগুনি রশ্মি অন্যদিকে অবলাল হয়েও শেষ হয়ে যায় না সেটি আরও বহুদূর বিস্তৃত হয়; তোমরা উপরের ক্লাসে সেগুলো জানতে পারবে।
প্রতিফলন, প্রতিসরণ ও শোষণ
তুমি যদি জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর আসা সূর্যের আলোতে একটা গ্লাসে পানি কানায় কানায় ভর্তি করে রেখে দাও, তাহলে তোমরা দেখতে পাবে পানির পৃষ্ঠদেশ থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘরের ছাদে এসে পড়েছে। ভালো করে লক্ষ করলে দেখবে সূর্যের আলো প্রতিসরিত হয়ে পানির ভেতর দিয়ে

গ্লাসের ভেতরে ঢুকে গেছে। শুধু তাই না তুমি যদি গ্লাসের পানিটা দীর্ঘ সময় রোদে রেখে দাও, তাহলে দেখবে পানিটা একটুখানি গরম হয়েছে, যার অর্থ সূর্যের আলো খানিকটা শোষিত হয়েছে।
এখানে বাতাসে ছিল একটা মাধ্যম, সূর্যের আলো সেই মাধ্যম থেকে অন্য আরেকটি মাধ্যমে পানিতে এসে পড়েছে। আলো যখনই একটা মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে এসে পড়ে তখনই প্রতিফলন, প্রতিসরণ এবং শোষণ এই তিনটি প্রক্রিয়া ঘটে থাকে।
কতটুকু আলো প্রতিফলিত হয়ে বাইরে বের হয়ে যাবে, কতটুকু প্রতিসরিত হয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে এবং কতটুকু শোষিত হবে সেটি নির্ভর করে মাধ্যম দুটোর প্রকৃতির উপর, কত কোণে আলোটি এসে পড়েছে ইত্যাদি বিষয়ের উপর।
একটু আগেই তোমরা জানতে পেরেছ একটা জিনিসের রং কী তার ওপর নির্ভর করে কোন রং কতটুকু শোষিত হবে। খালি চোখে যেটাকে স্বচ্ছ বা রংহীন মনে হয় সেটাতেও কিন্তু কমবেশি রং শোষিত হয়।

আলোর প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ কিছু নিয়ম মেনে চলে। একটা সমতল মেঝেতে একটা বল ছুড়ে মারলে সেটা যেভাবে ঠিক বিপরীত দিকে একই কোণে ছুটে যায়, আলোর প্রতিফলনের বেলায় ঠিক একই ব্যাপার ঘটে। এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যাওয়ার সময় আলো ঠিক একইভাবে বিপরীত দিকে প্রতিসরিত হয়।

আলোর প্রতিফলন আমাদের খুবই পরিচিত একটা ব্যাপার। আমরা প্রতিদিন আয়নায় আমাদের মুখ দেখি! আয়নায় নিজের চেহারা দেখার সময় আমরা সব সময় একটা বিষয় লক্ষ করেছি, প্রতিফলিত চেহারায় ডান এবং বাম সব সময় অদল বদল হয়ে যায়। তোমরা কি কখনো এটি কেন হয় চিন্তা করে দেখেছ? তোমরা কি এমন একটি আয়না তৈরি করতে পারবে যেখানে আমরা আমাদের চেহারা দেখলে দেখব আমাদের ডান এবং বাম অদল বদল
হয়নি?

কাজটি কঠিন নয়। ছবিতে দেখানো উপায়ে দুইটি আয়না ৯০ ডিগ্রি কোণে রাখো, দেখবে সেখানে তোমার চেহারা অদল বদল হয়নি। ডান হাত উপরে তুললে প্রতিফলিত চেহারাও ডান হাত উপরে তুলবে? কেন এটা হয় বলতে পারবে?
আলোর প্রতিসরণের আরও চমকপ্রদ একটি ব্যাপার ঘটে। আমরা সব সময়ই দেখে অভ্যস্ত যে আলো সরল রেখায় যায়। কিন্তু আলো যখন এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে ঢোকার চেষ্টা করে, তখন কিন্তু সেটা সরলরেখায় যায় না—আলোটা বাঁকা হয়ে ঢোকে।
যদি হালকা মাধ্যম (বাতাস) থেকে ঘন (পানি) মাধ্যমে যায়, তাহলে আলোর রেখাটি ভেতরের দিকে বেঁকে যাবে। যদি আলোটা ঘন মাধ্যম থেকে হালকা মাধ্যমে যায়, তাহলে বাইরের দিকে বেঁকে যায়।
বিষয়টা যে সত্যি তুমি সেটা খুব সহজে পরীক্ষা করে দেখতে পারো। একটা খালি কাপে একটা মুদ্রা রাখো যেন মুদ্রাটা তুমি দেখতে পারো। আলো যেহেতু সরলরেখার যায়, তাই বলা যায় এখন

মুদ্রাটা এবং তোমার চোখে এক সরলরেখায় আছে। এবারে তুমি তোমার মাথাটা ধীরে ধীরে পিছিয়ে নিতে থাক যেন মুদ্রাটা আর দেখা না যায়। এবারে কাপটাতে পানি ঢালতে থাকো, দেখবে মনে হবে মুদ্রাটা উপরে উঠে এসেছে এবং তুমি আবার সেটাকে দেখতে পাচ্ছ। আসলে মুদ্রাটা মুদ্রার জায়গাতেই আছে, আলোটাই বাঁকা হয়ে চোখে আসছে বলে আমরা সেটাকে দেখতে পাচ্ছি।
প্রতিসরণ ব্যবহার করেও আমরা অনেক কাজ করে থাকি। বাতাস থেকে কাচের ভেতর যাওয়ার সময় আলোর বেঁকে যাওয়ার ধর্ম ব্যবহার করে লেন্স তৈরি করা হয়। সেই লেন্স দিয়ে চোখের চশমা থেকে শুরু করে ক্যামেরা, দুরবিন, অণুবীক্ষণ যন্ত্র এরকম নানা ধরনের ব্যবহারিক যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয়।
তোমরা তোমাদের বই থেকে শুরু করে টেলিভিশন, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এরকম অনেক জায়গায় নানা ধরনের রং দেখে অভ্যস্ত। তোমাদের মনে হতে পারে এই রংগুলো তৈরি করার জন্য বুঝি সবগুলো রং ব্যবহার করতে হয়। আসলে সেটা সত্যি নয়, আমাদের চোখ মাত্র তিনটি রং দিয়ে সব রং দেখতে পারে।
বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য একটা স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে খুব সাবধানে ভিজে আঙুল ঝাঁকুনি দিয়ে খুবই সূক্ষ্ম একটা পানির বিন্দু রাখো তখন সেই পানির ফোঁটাটি কনভেক্স লেন্স হিসেবে কাজ করবে। তুমি দেখবে লাল, সবুজ এবং নীল, মাত্র এই তিনটি রং দিয়ে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে সব রং তৈরি করা হয়।
রঙিন আলো যখন চোখে এসে পড়ে তখন আমাদের চোখের রেটিনাতে এই লাল, নীল এবং সবুজ রংয়ের সংবেদী কোষগুলো নির্দিষ্ট রংয়ের অনুভূতি তৈরি করে এবং ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের সংমিশ্রণে আমরা ভিন্ন ভিন্ন রংগুলো দেখতে পাই। কোন কোন রংয়ের সংমিশ্রণে কোন কোন রং তৈরি হয়, সেটা বাম দিকের ছবিতে দেখানো হয়েছে। দেখতেই পাচ্ছ সমান পরিমাণ লাল, নীল এবং সবুজ রং দিয়ে সাদা রং তৈরি হয়।

এখানে তোমাদের অন্য একটা বিষয় মনে করিয়ে দেওয়া যায়, তুমি যদি একটা কাগজে রংতুলি দিয়ে লাল নীল সবুজ রং মিশাও তুমি কিন্তু বাম দিকের ছবিতে দেখানো রংগুলো পাবে না, ভিন্ন কিছু রং পাবে, সেই রংগুলোও ডান দিকের ছবিতে দেখানো হয়েছে। তোমরা যারা ছবি আঁকো তারা নিজেরাই নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ হলুদ লাল এবং নীল রং দিয়ে অন্য সব রং তৈরি করে ফেলা যায়।
স্মার্ট ফোন, টেলিভিশন কিংবা কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে আমাদের চোখের মধ্যে একই সঙ্গে লাল, নীল এবং সবুজ আলোর সংমিশ্রণ এসে পড়ে এবং চোখ তার জন্য নির্দিষ্ট রংয়ের অনুভূতি তৈরি করে। কাগজে রং মেশানোর সময় একটি রংয়ের কণার ওপর অন্য একটি রংয়ের কণা চলে আসার কারণে উপরের কণাটি নিচের কণার রং শোষণ করে, এবং যে রংটি শোষিত হয় না, শুধু সেটি বের হয়ে আসে। তখন তোমার চোখে লাল, নীল আর সবুজ রংয়ের মিশ্রণ এসে পড়ে না, শোষিত না হওয়া প্রকৃত রংটিই এসে পড়ে এবং তুমি সেই রংটিই দেখো ।
অনুশীলনী
১। রংধনু কেন বৃত্তাকার হয়?
২। ভর দুপুরে কেন কখনো রংধনু দেখা যায় না?


আরো পড়ুন : জীবের পুষ্টি ও বিপাক